ইহুদাবাদী ইসরায়েলকে ভারতের নির্লজ্জ সমর্থন
ইসরাইলকে ভারতের নির্লজ্জ সমর্থনের কারণ
- আপডেট সময় : ০৪:৫৭:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪ ৬১ বার পড়া হয়েছে
ইহুদীবাদী ইসরাইল ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বেশ পুরনো। দুই দেশের মধ্যে গড়ে উঠেছে কৌশলগত সম্পর্ক। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার ইসরায়েলি পর্যটক ভারতে ঘুরতে যায়। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভারতে অস্ত্র সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর তৃতীয় স্থানে আছে ইসরায়েল। ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে, ইহুদীবাদী ইসরাইলের প্রতি ভারতের নিঃশর্ত সমর্থনের মূল কারণ মুসলিম বিদ্বেষ এবং উগ্রবাদ। ভারতের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো শুরু থেকেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। হিন্দু মহাসভার নেতা ভিনায়ক দামোদার সাভারকার নৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়ে ইসরায়েলের জন্মকে সমর্থন করেছিলেন। আরএসএস নেতা মাদভ সাদাশিব গোলওয়ালকারও ইহুদি জাতীয়তাবাদের ভক্ত ছিলেন। গোলওয়ালকার বিশ্বাস করতেন যে, ফিলিস্তিনের প্রকৃত মালিক হলো ইহুদি জনগোষ্ঠী।
ইসরাইলের অস্তিত্ব গড়ে ওঠে ১৯১৭ সালে উপনিবেশবাদী ব্রিটেনের ব্যালফোর নামক ঘোষণার আলোকে এবং বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকে ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে অভিবাসন করতে উৎসাহ যুগিয়ে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল তার অস্তিত্ব ঘোষণা করে। সেই থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যার এবং গোটা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডগুলোকে দখলে নেয়ার নানা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় ভারতের অবস্থান ইসরায়েলের পক্ষে ছিল না। তখন ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী ইসরায়েলকে সমর্থন করেননি। মহাত্মা গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে, ইহুদিদের নিরাপদ একটি জায়গায় স্থানান্তর করা প্রয়োজন, কিন্তু তাই বলে তিনি ইহুদি কোনো রাষ্ট্রের জন্মকে মেনে নিতে পারেননি। গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে, ফিলিস্তিনের মাটির ওপর আরবদের অধিকারই বেশি ন্যায্য। সেই অবস্থানের কারণে ১৯৪৭ সালে ভারত ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল। ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্তিরও বিরুদ্ধেও ভোট দিয়েছিল।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী আততায়ীদের হাতে নিহত হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলের ব্যাপারে ভারতের অবস্থান বদলাতে থাকে। ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন, ‘ইসরায়েলকে আরও আগেই আমাদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, ইসরায়েল এখন আর কোনো বায়বীয় বিষয় নয়, বরং একটি বাস্তবতা। আমরা এতদিন আমাদের আরব বন্ধুদের স্পর্শকাতরতা ও প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে পারিনি, তবে আর নয়।
১৯৫৩ সালে ইসরায়েল ভারতের মুম্বাইয়ে প্রথম একটি কনসুলেট খোলার অনুমতি পায়। নেহেরুর সময়ে ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু হয়নি। নেহেরু ফিলিস্তিন ইস্যুকেও যৌক্তিক মনে করতেন। তার আশঙ্কা ছিল, ইসরায়েলকে যদি পূর্ণ দূতাবাস খোলার অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে আরব মিত্র দেশগুলো ভারতের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতে পারে।
১৯৯২ সাল থেকে ভারতের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক ভিন্নমাত্রায় উন্নীত হতে শুরু করে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে তেলআবিবে ভারত তার দূতাবাস চালু করে। কংগ্রেস আমলে ভারত দ্বৈত ভূমিকা পালন করে। একদিকে যেমন তারা ইসরায়েলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, অন্যদিকে মুসলিম ভোট না হারানোর ভয়ে তারা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনেরও নিন্দা জানায়।
ভারতের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছে ২০১৪ সালে গুজরাটের কসাই খ্যাত নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। ১৯৯৭ সালে আইজার ওয়েইজম্যান প্রথম ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারত সফর করেন। ২০০০ সালে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি প্রথম ভারতীয় মন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফরে যান।
২০০৩ সালে এরিয়েল শ্যারন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফরে আসেন। আর ২০১৭ সালে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েল সফর করেন। মোদির এ সফরের সময় তিনি ফিলিস্তিন সফর করেননি এবং ফিলিস্তিনের কোনো নেতার সাথে দেখাও করেননি।
নরেন্দ্র মোদির এ সফরের সময় ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে ৭টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই ৭টি চুক্তির আওতায় দুই দেশ মিলে যৌথভাবে ইন্ডিয়া-ইসরায়েল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশন তহবিল গড়ার পরিকল্পনা হয়। ভারতে পানি মজুদ ও শোধনাগার তৈরির বিষয়েও ইসরায়েল সম্মত হয়। পারমাণবিক প্রকল্পেও পরস্পরকে সহায়তা করতে দুই দেশের নেতারা সম্মত হন। ভারতে ছোট আকৃতির স্যাটেলাইট নির্মাণে সাহায্য করতেও ইসরায়েল আগ্রহ প্রকাশ করে।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত ও ইসরায়েলের সম্পর্কের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভারত সফরে আসেন। ইসরায়েল ভারতের পর্যটন খাত, প্রযুক্তি খাত, কৃষি ও উদ্ভাবনী সেক্টরে ৬৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতেও সম্মত হয়।
২০১৭ সাল থেকে ইসরায়েলি সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা দেশ হলো ভারত। বর্তমানে ভারত ও ইসরায়েলের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো প্রতিরক্ষা বিষয়ক লেনদেন। রাশিয়ার পর ভারতে ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সমরাস্ত্র রফতানি করে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রতিরক্ষা বিষয়ক লেনদেনের পরিমাণ ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দুই দেশের সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা একসাথে নিয়মিত কাজ করছে। ভারত ও ইসরায়েলের সেনারা নিয়মিতভাবে যৌথ মহড়াতেও অংশগ্রহণ করছে। বর্তমানে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ইসরায়েলের পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস চালু আছে। পাশাপাশি মুম্বাই ও ব্যাঙ্গালুরুতেও ইসরায়েলের পৃথক দুটি কনস্যুলেট কাজ করছে।
২০১৪ সাল থেকে এশিয়া মহাদেশে ইসরায়েলের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ হলো ভারত। প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ছাড়াই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর জাতিসংঘের বিভিন্ন ইসরায়েল বিরোধী প্রস্তাবনায় ভারত ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্ব নস্যাৎ করার জন্য ইসরায়েল যেসব প্রস্তাবনা এনেছে, নয়াদিল্লি এগুলোর প্রতিটিতেই ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করেছে। শুধু তাই নয়, ইসরায়েল বিরোধী রিজোলিউশনগুলোতে ভারতের প্রতিনিধি ভেটো দিয়ে ইসরায়েলকে নানাভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।
শুধু নীতি নির্ধারণী মহলই নয়, অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভারতের জনগনের মাঝে ইসরায়েলের বিষয়ে সহানুভূতি বেশি কাজ করে। ২০১১ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপ থেকে জানা যায়, ৫৬ শতাংশ আমেরিকান ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতিশীল। অপরদিকে ভারতের জনগনের ৫৯ শতাংশই ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এমনকি যেকোনো আগ্রাসী ভূমিকাকেও সমর্থন করে।
দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক এ দহরম মহরমের মূল কারণই হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিরক্ষা কার্যক্রমে ইসরায়েলের ওপর ভারতের নির্ভরতা। ভারত মনে করছে, ইসরায়েল হলো অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো উৎস। ২০১৬ সালে ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশাল একটি সামরিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়।
ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতিতে ইসরায়েলের কৌশল লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদের দমনে ও জমির অধিকার নিয়ন্ত্রণে ইসরায়েলের কৌশল নিয়েছে ভারত। চেতনাগতভাবে ইহুদিবাদীরা মনে করে, ‘ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের পুরো ভুখন্ডটি শুধুমাত্র তাদের জন্যই বরাদ্দ। আর যারা তাদের ধর্মবিশ্বাস ও চিন্তাচেতনা লালন করে না, এই ভুখন্ডে তাদের কোনো জায়গা নেই।’ অপরদিকে হিন্দুত্ববাদীরা মনে করেন, ভারতের মাটিতে শুধুমাত্র সেই সব মানুষই থাকতে পারবে ,যারা তাদের মতোই কট্টরপন্থী মানসিকতা লালন করে। এই উগ্রবাদীরাই ভারতের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল।
ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার পাশাপাশি গোয়েন্দা সহযোগিতাও বাড়ছে। ১৯৬৮ সালে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মোসাদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ ও ১৯৯২ সালে র’-এর কেনা দুটো বাড়ি মোসাদের অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার হিসেবে পরিচালিত হয়। যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীও অবগত ছিলেন। র’-এর গাড়ি ব্যবহার করেই মোসাদের কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার জম্মু ও কাশ্মিরে গিয়েছে বলেও খবরে জানানো হয়।
২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে জানায়, নরেন্দ্র মোদীর তুরস্কে একটি নির্ধারিত সফরের সময় ভারতের নিরাপত্তা কর্মীদের পাশাপাশি মোসাদের এজেন্ট এবং এমআই ফাইভের সদস্যদেরকেও নিয়োগ করা হয়। আনাতালিয়ায় জি-টোয়েন্টি সামিটে অংশ নেয়ার জন্য মোদি তুরস্ক সফরে গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে মোদির দ্বিতীয়বারের মতো তুরস্কে যাওয়ার কথা থাকলেও এরদোয়ান ভারতের কাশ্মির নীতির সমালোচনা করায় মোদি সে সফরটি বাতিল করে দেন।
ভারতের সামরিক বাহিনীকে শুধু অস্ত্র দিয়েই নয়, বরং সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রেও ইসরায়েল সহযোগিতা করেছে। কারগিল যুদ্ধের সময় জাগুয়ার এয়ারক্রাফট এবং মিরেজের জন্য ৫টি পৃথক পড দিয়ে সে সময় ইসরায়েল ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ভারতের বিমান বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা এয়ারমার্শাল রাগুনাথ নামবিয়ারও গণমাধ্যমে ইসরায়েলী এ সহায়তার কথা স্বীকার করেন। ভারত ও ইসরায়েল এখন অনেক বেশি মিত্ররাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর সেই দায়বদ্ধতা থেকেই ইসরায়েলের যে কোনো ধরনের অন্যায্য কার্যক্রমে এবং আগ্রাসী হামলায় নগ্ন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ভারত।